চট্টগ্রাম মহানগরীতে পাহাড় ধসে প্রাণহানির ঘটনা ঘটছে প্রতিবছরই। পাহাড় ধসরোধে জেলা প্রশাসন একটি শক্তিশালী পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটিও করেছে। কমিটি বর্ষা মৌসুমের আগে হাঁকডাক শুরু করে। বর্ষা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই কমিটির কার্যক্রমও থেমে যায়!

অবশ্য এই সময়ের মধ্যে কিছু পরিবারকে উচ্ছেদ এবং অন্যত্র সরিয়ে নেওয়া হয়। আবারও আগের অবস্থা ফিরে আসে। কোনোভাবেই থামানো যাচ্ছে না পাহাড় ধসে মৃত্যুর মিছিল। ২০০৭ সালের ১১ জুন ১২৭ জনসহ এই পর্যন্ত পাহাড় ধসের ঘটনায় ১৮০ জন প্রাণ হারিয়েছে।

এদিকে ১১ জুন ট্র্যাজেডি সাত বছর অতিক্রম করেছে গতকাল। কিন্তু এখনো পুরোপুরি বাস্তবায়িত হয়নি তদন্ত কমিটির ৩৬ সুপারিশ। প্রাণহানির ঘটনার পর ওই কমিটি গঠন করা হয়েছিল। কমিটি এসব সুপারিশ সরকারের উচ্চ পর্যায়ে জমা দেয়। সুপারিশগুলোর বেশির ভাগ এখনো ফাইলবন্দি।

চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার ও জেলা প্রশাসনের কার্যালয় থেকে প্রাপ্ত তথ্যমতে, ২০০৭ সালে ভয়াবহ পাহাড় ধসে ১২৭ প্রাণহানির ঘটনার পর উচ্চপর্যায়ে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছিল। ওই কমিটি তদন্ত শেষে পাহাড় ধসের ২৮ কারণ ও আটটি সুপারিশসহ ৩৬টি দফা নির্দেশনা বা পরামর্শ দেয়। পাহাড় ধসের কারণের মধ্যে ছিল, ভারী বর্ষণ, পাহাড়ে বালির আধিক্য, পাহাড়ের উপরিভাগে গাছ না থাকা, গাছ কেটে ভারসাম্য নষ্ট করা, পাদদেশে ঝুঁকিপূর্ণ বসতবাড়ি গড়ে তোলা, পাহাড় থেকে বৃষ্টির পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা না রাখা, বনায়নের পদক্ষেপের অভাব, বর্ষণে পাহাড় থেকে নেমে আসা বালি ও মাটি অপসারণে দুর্বলতা ইত্যাদি।

পাহাড় ধস বন্ধে সুপারিশমালার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল, পাহাড়ের ৫ কিলোমিটারের মধ্যে হাউজিং প্রকল্প না করা, জরুরি বনায়ন, গাইডওয়াল নির্মাণ, নিষ্কাশন ড্রেন ও মজবুত সীমানা প্রাচীর নির্মাণ করা, পাহাড়ের পানি ও বালি অপসারণের ব্যবস্থা করা, বসতি স্থাপনাসমূহ টেকসই করা, যত্রতত্র পাহাড়ি বালি উত্তোলন নিষিদ্ধ করা, পাহাড়ি এলাকার ১০ কিলোমিটারের মধ্যে ইটভাটা নিষিদ্ধ করা, মতিঝর্না ও বাটালি হিলের পাদদেশে অবৈধ বস্তি উচ্ছেদ করে পর্যটন স্পট করা, ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ের পাদদেশে বসতি স্থাপনা নিষিদ্ধ করা, পাহাড় কাটায় জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা, মহানগরীকে পাহাড়ি এলাকা হাটহাজারীর দিকে সমপ্রসারণ না করে কর্ণফুলীর দক্ষিণ পাড়ে পটিয়া ও আনোয়ারার দিকে সমপ্রসারণ ও বর্তমানে যেসব পাহাড় প্রায় খাড়া অবস্থায় রয়েছে সেসব পাহাড়ে স্বাভাবিক বনায়ন সম্ভব নয় বিধায় সেখানে মুলি বাঁশ, মিতিঙ্গা রোপণ ইত্যাদি।

২০০৭ সালের প্রাণহানির পর সরকার গঠিত ওই তদন্ত কমিটির সদস্য সচিব এবং পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক জাফর আলম বলেন, 'পাহাড়গুলোর সার্বিক অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে ভূমি ধসরোধে সুপারিশগুলো করা হয়েছিল। সুপারিশগুলোর মধ্যে অবৈধ বসতি উচ্ছেদসহ বেশ কিছু প্রস্তাব বাস্তবায়িত হয়েছে। তবে দীর্ঘ মেয়াদি সুপারিশগুলো বাস্তবায়িত হয়নি।'

সুপারিশগুলো বাস্তবায়ন না হওয়া বিষয়ে জেলা প্রশাসনের শক্তিশালী পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি ও চট্টগ্রামের বিভাগীয় কমিশনার মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ বলেন, 'বেশির ভাগ সুপারিশ বাস্তবায়ন হয়েছে। আরও কিছু সুপারিশ এখনো বাস্তবায়ন করা যায়নি।' এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, 'পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটির কার্যক্রম আগের চেয়ে গতিশীল হয়েছে। ইতোমধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড় চিহ্নিত, বসতঘর চিহ্নিত এবং বসতঘরগুলো অন্যত্র সরিয়ে নেওয়ার জন্য আশ্রয়কেন্দ্রের প্রাথমিক স্থানও নির্ধারণ করা হয়েছে। এছাড়া অবৈধ বসতঘর থেকে বিদ্যুৎ, পানি ও গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।' তিনি আরও বলেন, 'চলতি বছর নতুনভাবে জরিপ চালিয়ে ৩০টি পাহাড়কে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে এবং পাহাড়গুলোর মধ্যে সাড়ে ছয় শতাধিক বসতঘর অত্যধিক ঝুঁকিপূর্ণ। এসব বসতঘর অবশ্যই উচ্ছেদ করা হবে।'

বার বার সিদ্ধান্ত নিয়েও অবৈধ বসত উচ্ছেদ করতে না পারার বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক মেজবাহ উদ্দিন কালের কণ্ঠকে বলেন, 'এসব অবৈধ ঘর উচ্ছেদ করতে গেলে প্রভাবশালী একটি মহল নানাভাবে বাধার সৃষ্টি করে। এই কারণেই কিছুটা সমস্যা হয়। তবে আইন বাস্তবায়নে কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না।' তিনি বলেন, 'ঝুঁকিপূর্ণ ১১ পাহাড়ের ৬৬৬টি বসতঘর শিগগিরই সরিয়ে নেওয়া হবে।'

জেলা প্রশাসন থেকে প্রাপ্ত তথ্যমতে, চলতি বছর নতুনভাবে ৩০টি পাহাড়কে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।

এর মধ্যে রয়েছে সিআরবি পাহাড়, টাইগারপাস-লালখান বাজার রোড সংলগ্ন পাহাড়, টাইগারপাস মোড়ের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণ, মোজাফফর নগর, কাট্টলি থেকে সীতাকুণ্ড পর্যন্ত পাহাড়, সলিমপুর বাস্তুহারা পাহাড়, প্রবর্তক পাহাড়, গোল পাহাড়, ইস্পাহানী পাহাড়, বন গবেষণাগার ও বন গবেষণা ইনস্টিটিউট সংলগ্ন পাহাড়, জয় পাহাড়, চট্টেশ্বরী পাহাড়, মতিঝর্না ও বাটালি হিল সংলগ্ন পাহাড়, রেলওয়ে এমপ্লয়িজ গার্লস স্কুল পাহাড়, আকবর শাহ আবাসিক এলাকা সংলগ্ন পাহাড়, ফয়'স লেক আবাসিক এলাকা পাহাড়, জালালাবাদ হাউজিং সোসাইটি সংলগ্ন পাহাড়, বায়তুল আমান হাউজিং সোসাইটি পাহাড়, ডিসি হিলের একাংশ, পরিবেশ অধিদপ্তর সংলগ্ন সিটি কর্পোরেশনের পাহাড়, এ কে খান অ্যান্ড কোং এর পাহাড়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মালিকানাধীন পাহাড়, কৈবল্যধামস্থ বিশ্ব কলোনি পাহাড়, চট্টেশ্বরী রোডের জে এফ বাংলাদেশের পাহাড়, জামেয়াতুল উলুম ইসলামী মাদ্রাসা পাহাড়, ফরেস্ট রিসার্চ একাডেমি সংলগ্ন মীর হাসান এর ব্যক্তিমালিকানাধীন পাহাড়, ইস্পাহানী পাহাড়ের দক্ষিণ পাশের হারুণ খান সাহেবের পাহাড়, নাসিরাবাদ শিল্প এলাকা সংলগ্ন পাহাড়, লেক সিটি আবাসিক এলাকার পাহাড় এবং নগরীর জিইসি মোড়ের ব্লোসোম গার্ডেন নামের সৈয়দ জিয়াদ হোসেনের ব্যক্তি মালিকানাধীন পাহাড়।


Disclaimer:

This post might be introduced by another website. If this replication violates copyright policy in any way without attribution of its original copyright owner, please make a complain immediately to this site admin through Contact.