১৯৫৫ থেকে ১৯৭৫ প্রায় ২০
বছরব্যাপী ভিয়েতনাম যুদ্ধে
দক্ষিণ কোরিয়া, অস্ট্রেলিয়া,
নিউজিল্যান্ড, ফিলিপাইন,
তাইওয়ান ও থাইল্যান্ডের সাথে
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও তার সর্বশক্তি
নিয়ে দাঁড়িয়েছিল উত্তর
ভিয়েতনামের বিরুদ্ধে। চীন,
উত্তর কোরিয়া, সোভিয়েত
ইউনিয়ন ও কিউবার সহায়তায় সেই
শক্তিশালী সম্মিলিত
বাহিনীকে পরাজিত করে হো
চি মিনের নেতৃত্বে উত্তর ও
দক্ষিণ ভিয়েতনাম একীভূত হয় এই
রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর। ভিয়েতনাম
যুদ্ধে যুদ্ধের যাবতীয় নীতিকে
বুড়ো আঙুল দেখিয়ে মার্কিন
বাহিনী নির্বিচারে হত্যা
করেছিল ভিয়েতনামের নিরস্ত্র
নিরপরাধ মানুষদের।
.
১ম ব্যাটালিয়ন, ২০তম ইনফ্যান্ট্রি
রেজিমেন্ট, ১১তম ব্রিগেড ও ২৩তম
ইনফ্যান্ট্রি ডিভিশন নিয়ে গঠিত
ছিল মার্কিন বাহিনীর ‘চার্লি
কোম্পানি’। আর ৪র্থ ব্যাটালিয়ন
ও ৩য় ইনফ্যান্ট্রি রেজিমেন্ট
নিয়ে গঠিত ছিল ‘ব্র্যাভো
কোম্পানি’। এই দুই কোম্পানি
সৈন্যের মিলিত আক্রমণে
ভিয়েতনামের কোয়াং নাগাই
প্রদেশে ঘটেছিল এক ভয়ঙ্কর
হত্যাযজ্ঞ। ৫০৪ জন নিরস্ত্র
গ্রামবাসীকে ঠাণ্ডা মাথায় খুন
করেছিল মার্কিন সেনারা।
কুখ্যাত সেই মি-লাই গণহত্যা,
যেটি সনমি গণহত্যা নামেও
পরিচিত, সেটি নিয়েই আজকের
লেখা।
.
১৯৬৮ সাল। মার্চের ১৬ তারিখ
শনিবার, সকাল সাড়ে সাতটা।
ক্যাপ্টেন আর্নেস্ট মেডিনার
নেতৃত্বে চার্লি কোম্পানি
থেকে ১০০ সৈন্যের একটি দল
পৌঁছাল সনমি গ্রামে। সাথে
আছে কামান ও অস্ত্রসজ্জিত
হেলিকপ্টার। সনমি গ্রামটি গড়ে
উঠেছিল অনেকগুলো জনবসতি
নিয়ে। এগুলোর মধ্যে মি-লাই,
কো-লুই, মি-খে, তু-কুং এগুলো
ছিল বড় বড় জনবসতি। বাড়ি-ঘর,
ধানের ক্ষেত, সেঁচের জন্য
নির্মিত খাল, বাঁধ, মাটির
রাস্তা- সব কিছু মিলিয়ে
একেকটা সাধারণ শান্ত পল্লীই
ছিল এগুলো। মার্কিন সৈন্যরা এমন
ভাবে সেখানে হাজির
হয়েছিল। যেন এ শান্ত গ্রামগুলোর
মধ্যেই কোথাও লুকিয়ে আছে
ভিয়েত কং এর গেরিলা
যোদ্ধারা।
.
অপারেশনের পরিকল্পনা
অনুযায়ী, সকাল ৮ টায় উইলিয়াম
ক্যালির নেতৃত্বে প্রথম প্লাটুন
এবং স্টিফেন ব্রুকসের নেতৃত্বে
দ্বিতীয় প্লাটুনের সৈন্যরা লাইন
ধরে প্রবেশ করল তু-কুং পল্লীতে।
জেফ্রি ল্যাক্রসের নেতৃত্বে
তৃতীয় প্লাটুন এবং ক্যাপ্টেন
মেডিনার কমান্ড পোস্ট বাইরে
রইল। কিছুক্ষণের মধ্যে ধানের
ক্ষেতে কিংবা ঝোপের
আশেপাশে যে কজন
গ্রামবাসীকে দেখা গেল
তাদের দিকে গুলি ছুঁড়েই শুরু হল
হত্যাযজ্ঞ।
.
গ্রামবাসী তখন কেবল দিনের শুরু
করার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে।
সৈন্যরা তাদের মাঝখান দিয়ে
হেঁটে যাচ্ছে দেখে তারা
কিন্তু শুরুতেই আতঙ্কিত হয়ে পড়ে
নি। হ্যারি স্ট্যানলি নামের
একজন সৈন্য পরবর্তীতে
জিজ্ঞাসাবাদে জানায় তার
সেদিনের আক্রমণ শুরুর
অভিজ্ঞতার কথা। প্রথম আক্রমণের
ঘটনা হিসেবে সে দেখেছিল,
একজন মার্কিন সৈন্য একটা
লোককে বেয়নেট দিয়ে খোঁচা
দিল। কিছুক্ষণ পর সে সৈন্যটি
আরেকজনকে ধাক্কা দিয়ে
ফেলে দিল একটা কুয়ার মধ্যে।
তারপর সে কুয়াটার ভেতরে ছুঁড়ে
দিল একটা গ্রেনেড। কিছুক্ষণ পর
স্ট্যানলি দেখল, পনের-বিশজন
মানুষ, যাদের প্রায় সবাই নারী
বা শিশু, হাঁটু গেড়ে বসে আছে
একটা মন্দিরের পাশে। তাদের
সবার গায়েই আগুন ধরিয়ে দেয়া
হয়েছিল। কাঁদতে কাঁদতে তারা
প্রার্থনা করছিল বাঁচবার জন্য।
এরপর প্রত্যেকের মাথায় গুলি
করে মেরে ফেলা হল তাদের।
.
তু-কুং ছিল জম-ল্যাং নামক
পল্লীর মধ্যকার একটি জনবসতি। এই
বসতির অধিবাসী ছিল প্রায় ৭০০
জনের মত। এখানেই ঢুকেছে প্রথম
প্লাটুনের সৈন্যরা। নির্বিচার
হত্যাকাণ্ড চলছিল একের পর এক।
এক পর্যায়ে তারা জম-ল্যাং এর
প্রায় ৭০-৮০ জন গ্রামবাসীকে
নিয়ে গেল গ্রামের পূর্বদিকে,
যেখানে সেঁচের জন্য বাঁধ তৈরি
করা হয়েছিল। এরপর তাদের
সবাইকে লাথি দিয়ে ফেলা হল
সেই বাঁধের মধ্যে। লেফট্যানেন্ট
ক্যালি নির্দেশ দিল তাদেরকে
গুলি করবার। নিজেও শুরু করল গুলি।
অনেক নারীর কোলে ছিল শিশু।
তারা কাঁদতে কাঁদতে বলছিল,
‘নো ভিসি, নো ভিসি’! মানে
বলতে চাইছিল যে, তারা
ভিয়েত কং এর কেউ নয়। কিন্তু
মার্কিন সেনারা এমন ভাবে
গুলি করে যাচ্ছিল, যেন সে
মায়েরা আর তাদের কোলের
শিশুরাও ভয়ঙ্কর শত্রু। বুলেটে
ঝাঁজরা করে দিয়ে তাদের মৃত্যু
নিশ্চিত করছিল ক্যালির অনুগত
বাহিনী। পল মিডলো নামক এক
মার্কিন সেনা পরবর্তীতে
জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছিল,
সে তার ‘এম সিক্সটিন’
রাইফেলের কয়েকটা ম্যাগাজিন
শেষ করে ফেলেছিল গুলি করতে
করতে। আপনাদের অবগতির জন্য
জানাই, এম সিক্সটিন রাইফেলের
ম্যাগাজিনে সাধারণত গুলি
থাকে অন্তত ৩০ রাউন্ড। পল
মিডলো এই নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ডের
পুরো সময় জুড়েই লেফট্যানেন্ট
ক্যালির পাশে ছিল।
.
জিজ্ঞাসাবাদে ডেনিস কন্টি
নামক এক সৈন্যের কাছ থেকে
জানা যায় সেই হত্যাযজ্ঞের
মধ্যেও এক করুণতম কাহিনী। সে
জানায়, অনেক নারী তাদের
শিশুদের উপর শুয়ে পড়েছিলেন
গুলির হাত থেকে বাঁচানোর জন্য।
গুলিতে মায়েদের মৃত্যুর পর নিথর
লাশগুলোর নীচ থেকে হাঁটতে
শিখেছে এমন শিশুরা বেরিয়ে
আসছিল। তারা দাঁড়াতে না
দাঁড়াতেই ক্যালি গুলি ছুঁড়ে
হত্যা করছিল একে একে।
গ্রামবাসীর অনেক গরু-ছাগলকে
পর্যন্ত গুলি করে মেরেছিল
সৈন্যরা।
দলের সাথে এসেও কয়েকজন সৈন্য
এই নারকীয় হত্যাকাণ্ডে
সক্রিয়ভাবে জড়িত হয়নি।
মাইকেল বার্নহার্ড নামক এক
সৈন্য ছিল তেমনই একজন। সে দলের
পেছনের দিকে ছিল এবং জম-
ল্যাং গ্রামে প্রবেশ করেছিল
অনেকের পরে। বার্নহার্ডের
জবানিতে জানা যায় গণহত্যার
সেই ভয়াবহ দৃশ্যের কথা।
.
বার্নহার্ড বলে, “আমি গ্রামের পথ
ধরে এগিয়ে যেতে যেতে
সৈন্যদের নিষ্ঠুর সব কর্মকাণ্ড
দেখছিলাম। তারা মানুষের
কুঁড়েঘরগুলোতে আগুন ধরিয়ে
দিচ্ছিল। এরপর যখন ঘরের ভেতর
থেকে লোকজন বেরিয়ে আসছিল,
সাথে সাথে গুলি করে মারছিল
তাদের। ঘরের ভেতরে ঢুকেও
গুলি করছিল কেউ কেউ। কেউ
আবার কিছু গ্রামবাসীকে দল
বেঁধে দাঁড় করিয়ে তারপর গুলি
করছিল। যেদিকেই যাচ্ছিলাম, শুধু
লাশ আর লাশ। কিছু সুস্থ জীবন্ত
মানুষকে একদাথে দাঁড় করিয়ে
তাদের দিকে ছুঁড়ে মারা হচ্ছিল
গ্রেনেড। নারী আর শিশু কিছুই
বাছবিচার না করে গুলি চলছিল।
গ্রামবাসীর পক্ষ থেকে সৈন্যরা
বিন্দুমাত্র প্রতিরোধের সম্মুখীন
হয়নি।” বার্নহার্ড আরও বলে,
“আমাদের পক্ষের দিকে কোনো
ক্ষতিই হয় নি। এটা ছিল খুব
সাধারণ একটা গ্রাম। বৃদ্ধ বাবা,
সন্তান, নারী, শিশুদের নিয়েই
যেমন আর দশটা ভিয়েতনামের
গ্রাম, তেমনই। সত্যি কথা বলতে,
আমার মনেই পড়ে না, গোটা
গ্রামে সৈন্যদের বয়সী একজন পুরুষও
দেখেছি কিনা, না জীবিত না
মৃত।”
বার্নহার্ডের মত আরেক মার্কিন
সৈন্য রোনাল্ড হিবার্লিও
বলেছিল নিজের চোখে দেখা
নারকীয়তার কথা। “পনেরজনের মত
মানুষ, যাদের মধ্যে নারী আর
শিশুও ছিল, প্রায় একশ গজ দূরে
মেঠোপথ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল।
আচমকা সৈন্যরা রাইফেল তাক
করে গুলি করা শুরু করল তাদের
দিকে। শুধু গুলি নয়, গ্রেনেড
লাঞ্চার দিয়ে তারা গ্রেনেডও
ছুড়তে লাগল সেই মানুষগুলোর
দিকে। যা দেখছিলাম তাতে
নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে
পারছিলাম না।”
.
দ্বিতীয় প্লাটুনের সৈন্যরা মি-
লাই এর উত্তরাংশে অভিযান
চালিয়ে ৬০ থেকে ৭০ জনকে
হত্যা করে। মাইন আর বুবি
ট্র্যাপের মধ্যে পড়ে নিহত হয় এক
মার্কিন সেনা এবং আহত হয় সাত
জন। প্রথম ও দ্বিতীয় প্লাটুনের বর্বর
অভিযানের পর তৃতীয় প্লাটুনকে
নির্দেশ দেয়া হয় ‘বাকি’ যারা
আছে তাদের নির্মূল করার জন্য।
তখন তৃতীয় পাটুনের সদস্যরা আরও
সাত থেকে বারো জনকে খুঁজে
বের করে হত্যা করে।
ওদিকে, চার্লি কোম্পানির
সেনাদের এই হত্যাযজ্ঞ থেকে
তিন কিলোমিটার দূরে সকাল
সাড়ে আটটার দিকে পৌঁছেছিল
‘ব্র্যাভো কোম্পানি’র সৈন্যদের
একটি দল। এই দলটি আক্রমণ করে
কো-লুই পল্লীর মি-হোই নামক
জনবসতিতে। সেখানেও চলে এমন
নারকীয় হত্যাকাণ্ড। এই আক্রমণে
নিহত হয় অন্তত ৬০ থেকে ১৫৫ জন
মানুষ।
.
পরদিন পর্যন্ত দুই কোম্পানির
সৈন্যরা মিলে গ্রামের
বাড়িগুলোতে আগুন লাগায়,
তাদের জিনিসপত্র নষ্ট করে এবং
বন্দীদের উপর নির্যাতন চালায়।
জর্জিয়া সাদার্ন
বিশ্ববিদ্যালয়ের সামরিক
ইতিহাস বিষয়ের অধ্যাপক
উইলিয়াম থমাস এলিসন বলেন,
সকাল শেষ হতে না হতেই চার্লি
কোম্পানির সেনারা কয়েকশ
বেসামরিক মানুষকে হত্যা
করেছিল। এর মধ্যে তারা ধর্ষণ
করে অসংখ্য নারী ও
কিশোরীকে। সৈন্যরা শত্রুপক্ষের
কোনো অস্ত্রের সম্মুখীনই হয় নি
এবং মি-লাই জনবসতিতে কোনো
অস্ত্র খুঁজেও পাওয়া যায় নি।
হিউ থম্পসন ছিলেন একজন পাইলট
যিনি হেলিকপ্টার নিয়ে
সেনাদলের সাথে এসেছিলেন
প্রয়োজনীয় সহায়তা করবার জন্য।
সনমি গ্রামের উপর দিয়ে
হেলিকপ্টার নিয়ে যাবার সময়
তিনি মৃত ও আহত মানুষদের
দেখতে পান। সেই বাঁধের পাশে
তিনি হেলিকপ্টার নিয়ে অবতরণ
করেন যেটা ছিল লাশ দিয়ে
পরিপূর্ণ। লাশের মধ্যেও কোথাও
কোথাও একটু আধটু নড়াচড়া দেখা
যাচ্ছিল। থম্পসন সেখানে চার্লি
কোম্পানির এক সার্জেন্ট
ডেভিড মিশেলের কাছে
জিজ্ঞেস করেন আহতদের
চিকিৎসা সাহায্য করবেন কিনা।
মিশেল উত্তর দেয়, তাদেরকে
কেবল মরে যেতে সাহায্য করতে
পার। এ কথা শুনে হতভম্ব হয়ে থম্পসন
এরপর লেফট্যানেন্ট ক্যালির
সাথে কথা বলতে গেলে ক্যালি
জানায়, সে শুধুই নির্দেশ পালন
করছে। এরপর হেলিকপ্টার নিয়ে
সেখান থেকে সরে যাবার সময়
থম্পসন দেখে, সার্জেন্ট মিশেল ঐ
বাঁধের মধ্যে আবার গুলি করছে।
.
থম্পসন হেলিকপ্টার থেকে
দেখেছিল, ক্যাপ্টেন মেডিনা
একজন নিরস্ত্র নারীকে লাথি
মেরে এরপর তার দিকে পয়েন্ট
ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জে গুলি করে হত্যা
করে। পরবর্তীতে মেডিনা
বলেছিল, তার নাকি মনে
হয়েছে ওই নারীর কাছে হ্যান্ড
গ্রেনেড ছিল! এরপর এক জায়গায়
থম্পসন দেখল, একটা বড় বাঙ্কার বা
গর্তের ভেতরে লুকিয়ে আছে
ভীত সন্ত্রস্ত কতগুলো মানুষ আর
একদল সৈন্য এগিয়ে যাচ্ছে
সেটার দিকে। থম্পসন সে
জায়গায় অবতরণ করে। সে তার
হেলিকপ্টারের ক্রুদের নির্দেশ
দেয়, যদি বাঙ্কার থেকে
মানুষগুলোকে বের করে আনার সময়
কোনো মার্কিন সেনা এদেরকে
গুলি করার চেষ্টা করে তাহলে
সেই সেনাদের দিকেই গুলি
চালাতে। এরপর থম্পসন
সেখানকার অধিনায়ক
লেফট্যানেন্ট স্টিফেন ব্রুকসকে
গিয়ে বলে, এই বাঙ্কারে নারী
ও শিশু আছে, তাদেরকে বের করে
আনতে হবে। তখন ব্রুকস জবাব দেয়,
তাদেরকে বের করে আনার
একটাই উপায়, সেটা হল
বাঙ্কারে গ্রেনেড নিক্ষেপ
করা। তখন থম্পসন তাকে বলে
সৈন্যদের নির্দেশ দিতে যাতে
গুলি চালানো না হয়। এরপর সে
গিয়ে বাঙ্কার থেকে
লোকগুলোকে বের করে তাদের
হেলিকপ্টারে করে নিরাপদ
জায়গায় পৌঁছে দেয়।
.
মি-লাইয়ে আবার সেই বাঁধের
কাছে ফিরে আসে থম্পসন।
বাঁধের মধ্যে তখনও কিছুর নড়াচড়া
দেখতে পেয়ে সেখানে আবার
নামে। একজন ক্রু সেই বাঁধের মধ্যে
নেমে সেখান থেকে তুলে
নিয়ে আসে একটা চার বছরের
ছোট্ট শিশুকে যে এতকিছুর
ভেতরেও অক্ষত অবস্থায় ছিল।
শিশুটিকে নিরাপদ জায়গায়
রেখে আসা হয়। মি-লাই থেকে
ফেরার পর থম্পসন তার বৈমানিক
কোম্পানির কমান্ডারের কাছে
রিপোর্ট করে সেনাদের নিষ্ঠুর
হত্যাকাণ্ডের বর্ণনা দিয়ে। তার
হেলিকপ্টারের অন্য পাইলট এবং
ক্রুরাও থম্পসনের বর্ণনার পক্ষে
সাক্ষ্য দেয়।
.
এই পুরো হত্যাকাণ্ডকে মার্কিন
বাহিনীর বিভিন্ন রিপোর্টে
‘ভিয়েত কংদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’
হিসেবে দেখানো হয়েছিল।
১২৮ জন ভিয়েত কং সৈন্য এতে
নিহত হয়েছে বলে জানানো হয়
রিপোর্টে। এমনকি ক্যাপ্টেন
মেডিনাকে সাহসীকতার জন্য
একটি প্রশংসাপত্রও দেয়া হয়!
মার্কিন বাহিনী এমন সব
হত্যাকাণ্ড নিয়মিতই চালিয়ে
যাচ্ছিল। মি-লাই গণহত্যার ছয় মাস
পর এক মার্কিন সৈন্য
সেনাপ্রধানের নিকট চিঠি
লিখেছিল এসব অন্যায় হত্যার
বর্ণনা দিয়ে। তৎকালীন মেজর ও
পরবর্তীতে মার্কিন
পররাষ্ট্রমন্ত্র ী কলিন পাওয়েল
সে চিঠির ভিত্তিতে একটি
রিপোর্ট তৈরির দায়িত্ব পান
এবং মার্কিন সেনাদের এমন
কর্মকাণ্ডের কথা সম্পূর্ণ অস্বীকার
করেন সেই রিপোর্টে।
.
মি-লাইয়ে থম্পসনের ভূমিকার জন্য
তাকে ‘ডিস্টিংগুয়িশড ফ্লাইং
ক্রস’ পুরস্কার দেয়া হয়েছিল।
কিন্তু পুরস্কারের বর্ণনা হিসেবে
এক জায়গায় লেখা ছিল, সে
নাকি মি-লাইয়ে দুই পক্ষের মধ্যে
ভয়ঙ্কর যুদ্ধ চলাকালীন একটি
শিশুকে উদ্ধার করেছিল। এমন
মিথ্যা বর্ণনা দেখে পুরস্কারের
মেডেল ছুঁড়ে ফেলে দেয় থম্পসন।
১৯৯৮ সালে মার্কিন
সেনাবাহিনী আবার তাকে
পুরস্কৃত করতে চায় ‘সোলজার’স
মেডেল’ দিয়ে। এই পুরস্কারের
বর্ণনায় ছিল, ‘ভিয়েতনামের
বেসামরিক মানুষের উপর মার্কিন
বাহিনীর অন্যায় গণহত্যা
চালানোর সময় অন্তত ১০ জনের
জীবন রক্ষা করে বীরত্ব প্রদর্শনের
জন্য’ এই পুরস্কার। এই মেডেলটি
থম্পসনকে গোপনে দিয়ে কাজ
সারতে চেয়েছিল
সেনাবাহিনী। তখন সে জানায়,
সে মেডেলটি নেবে যদি এটি
জনসম্মুখে দেয়া হয় এবং যদি তার
হেলিকপ্টারের ক্রুদেরও একই
পুরস্কার দেয়া হয়।
.
মি-লাই গণহত্যার প্রায় এক বছর আট
মাস পর সিমোর হার্শ নামক এক
ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক পুরো
ঘটনা নিয়ে অনুসন্ধানী রিপোর্ট
প্রকাশ করেন এসোসিয়েটেড
প্রেসের মাধ্যমে। সে সূত্রে এ
নিয়ে রিপোর্ট করে টাইম, লাইফ,
নিউজউইক ইত্যাদি ম্যাগাজিন ও
সিবিএস টেলিভিশন। ‘প্লেইন
ডিলার’ নামের একটি পত্রিকা
প্রকাশ করে গণহত্যার কিছু ছবি।
.
এর পরপরই অভিযুক্ত সৈন্যদের
বিরুদ্ধে কোর্ট মার্শালের
উদ্যোগ নেয়া হয়। এই কোর্ট
মার্শালে মার্কিন অফিসার ও
সৈনিক মিলিয়ে মোট ২৬ জনের
বিচার শুরু হয়, এবং শেষ পর্যন্ত
কেবল লেফট্যানেন্ট ক্যালিকে
শাস্তি দেয়া হয়। লেফট্যানেন্ট
ক্যালি পরে স্বীকার করেছিল
তার জঘন্য কর্মকাণ্ডের কথা।
বাঁধের মধ্যে পরে থাকা
মানুষগুলোকে মাত্র ৫ ফুট দূরে
দাঁড়িয়ে গুলি করে মেরেছিল
সে। কিন্তু এ সবই ‘আদেশ পালন’
হিসেবে উল্লেখ করেছিল
ক্যালি। তার যাবজ্জীবন
কারাদণ্ড হলেও দুদিন পরেই
প্রেসিডেন্ট নিক্সন তাকে
কারাগার থেকে মুক্তি দিয়ে
শুধুমাত্র গৃহবন্দী রাখার নির্দেশ
দেন। সব মিলিয়ে সাড়ে তিন বছর
গৃহবন্দি ও এর মাঝখানে তিন মাস
কারাবন্দী হওয়াটাই ছিল
ক্যালির অপরাধের শাস্তি। ১৯৭৪
সালের সেপ্টেম্বরে তাকে
প্যারোলে মুক্তি দিয়ে দেয়া
হয়।
.
এই ছিল ভিয়েতনাম যুদ্ধের মি-
লাই গণহত্যার মার্কিনী বিচার।
৫০৪ জন নিরপরাধ নিরস্ত্র মানুষকে
গুলি আর বোমা দিয়ে হত্যা
করেও সে হত্যাকাণ্ডের
নির্দেশদাতা অফিসারদের
কোনো বিচার তো হয়ই নি, তার
উপর দ্বিতীয় সারির একজন
অফিসারকে সামান্য শাস্তি
দিয়েও আবার ছেড়ে দেয়া
হয়েছিল। এই হল সারা পৃথিবীতে
‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’
চালানো মার্কিন বাহিনীর
নৈতিকতার ইতিহাস।
বছরব্যাপী ভিয়েতনাম যুদ্ধে
দক্ষিণ কোরিয়া, অস্ট্রেলিয়া,
নিউজিল্যান্ড, ফিলিপাইন,
তাইওয়ান ও থাইল্যান্ডের সাথে
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও তার সর্বশক্তি
নিয়ে দাঁড়িয়েছিল উত্তর
ভিয়েতনামের বিরুদ্ধে। চীন,
উত্তর কোরিয়া, সোভিয়েত
ইউনিয়ন ও কিউবার সহায়তায় সেই
শক্তিশালী সম্মিলিত
বাহিনীকে পরাজিত করে হো
চি মিনের নেতৃত্বে উত্তর ও
দক্ষিণ ভিয়েতনাম একীভূত হয় এই
রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর। ভিয়েতনাম
যুদ্ধে যুদ্ধের যাবতীয় নীতিকে
বুড়ো আঙুল দেখিয়ে মার্কিন
বাহিনী নির্বিচারে হত্যা
করেছিল ভিয়েতনামের নিরস্ত্র
নিরপরাধ মানুষদের।
.
১ম ব্যাটালিয়ন, ২০তম ইনফ্যান্ট্রি
রেজিমেন্ট, ১১তম ব্রিগেড ও ২৩তম
ইনফ্যান্ট্রি ডিভিশন নিয়ে গঠিত
ছিল মার্কিন বাহিনীর ‘চার্লি
কোম্পানি’। আর ৪র্থ ব্যাটালিয়ন
ও ৩য় ইনফ্যান্ট্রি রেজিমেন্ট
নিয়ে গঠিত ছিল ‘ব্র্যাভো
কোম্পানি’। এই দুই কোম্পানি
সৈন্যের মিলিত আক্রমণে
ভিয়েতনামের কোয়াং নাগাই
প্রদেশে ঘটেছিল এক ভয়ঙ্কর
হত্যাযজ্ঞ। ৫০৪ জন নিরস্ত্র
গ্রামবাসীকে ঠাণ্ডা মাথায় খুন
করেছিল মার্কিন সেনারা।
কুখ্যাত সেই মি-লাই গণহত্যা,
যেটি সনমি গণহত্যা নামেও
পরিচিত, সেটি নিয়েই আজকের
লেখা।
.
১৯৬৮ সাল। মার্চের ১৬ তারিখ
শনিবার, সকাল সাড়ে সাতটা।
ক্যাপ্টেন আর্নেস্ট মেডিনার
নেতৃত্বে চার্লি কোম্পানি
থেকে ১০০ সৈন্যের একটি দল
পৌঁছাল সনমি গ্রামে। সাথে
আছে কামান ও অস্ত্রসজ্জিত
হেলিকপ্টার। সনমি গ্রামটি গড়ে
উঠেছিল অনেকগুলো জনবসতি
নিয়ে। এগুলোর মধ্যে মি-লাই,
কো-লুই, মি-খে, তু-কুং এগুলো
ছিল বড় বড় জনবসতি। বাড়ি-ঘর,
ধানের ক্ষেত, সেঁচের জন্য
নির্মিত খাল, বাঁধ, মাটির
রাস্তা- সব কিছু মিলিয়ে
একেকটা সাধারণ শান্ত পল্লীই
ছিল এগুলো। মার্কিন সৈন্যরা এমন
ভাবে সেখানে হাজির
হয়েছিল। যেন এ শান্ত গ্রামগুলোর
মধ্যেই কোথাও লুকিয়ে আছে
ভিয়েত কং এর গেরিলা
যোদ্ধারা।
.
অপারেশনের পরিকল্পনা
অনুযায়ী, সকাল ৮ টায় উইলিয়াম
ক্যালির নেতৃত্বে প্রথম প্লাটুন
এবং স্টিফেন ব্রুকসের নেতৃত্বে
দ্বিতীয় প্লাটুনের সৈন্যরা লাইন
ধরে প্রবেশ করল তু-কুং পল্লীতে।
জেফ্রি ল্যাক্রসের নেতৃত্বে
তৃতীয় প্লাটুন এবং ক্যাপ্টেন
মেডিনার কমান্ড পোস্ট বাইরে
রইল। কিছুক্ষণের মধ্যে ধানের
ক্ষেতে কিংবা ঝোপের
আশেপাশে যে কজন
গ্রামবাসীকে দেখা গেল
তাদের দিকে গুলি ছুঁড়েই শুরু হল
হত্যাযজ্ঞ।
.
গ্রামবাসী তখন কেবল দিনের শুরু
করার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে।
সৈন্যরা তাদের মাঝখান দিয়ে
হেঁটে যাচ্ছে দেখে তারা
কিন্তু শুরুতেই আতঙ্কিত হয়ে পড়ে
নি। হ্যারি স্ট্যানলি নামের
একজন সৈন্য পরবর্তীতে
জিজ্ঞাসাবাদে জানায় তার
সেদিনের আক্রমণ শুরুর
অভিজ্ঞতার কথা। প্রথম আক্রমণের
ঘটনা হিসেবে সে দেখেছিল,
একজন মার্কিন সৈন্য একটা
লোককে বেয়নেট দিয়ে খোঁচা
দিল। কিছুক্ষণ পর সে সৈন্যটি
আরেকজনকে ধাক্কা দিয়ে
ফেলে দিল একটা কুয়ার মধ্যে।
তারপর সে কুয়াটার ভেতরে ছুঁড়ে
দিল একটা গ্রেনেড। কিছুক্ষণ পর
স্ট্যানলি দেখল, পনের-বিশজন
মানুষ, যাদের প্রায় সবাই নারী
বা শিশু, হাঁটু গেড়ে বসে আছে
একটা মন্দিরের পাশে। তাদের
সবার গায়েই আগুন ধরিয়ে দেয়া
হয়েছিল। কাঁদতে কাঁদতে তারা
প্রার্থনা করছিল বাঁচবার জন্য।
এরপর প্রত্যেকের মাথায় গুলি
করে মেরে ফেলা হল তাদের।
.
তু-কুং ছিল জম-ল্যাং নামক
পল্লীর মধ্যকার একটি জনবসতি। এই
বসতির অধিবাসী ছিল প্রায় ৭০০
জনের মত। এখানেই ঢুকেছে প্রথম
প্লাটুনের সৈন্যরা। নির্বিচার
হত্যাকাণ্ড চলছিল একের পর এক।
এক পর্যায়ে তারা জম-ল্যাং এর
প্রায় ৭০-৮০ জন গ্রামবাসীকে
নিয়ে গেল গ্রামের পূর্বদিকে,
যেখানে সেঁচের জন্য বাঁধ তৈরি
করা হয়েছিল। এরপর তাদের
সবাইকে লাথি দিয়ে ফেলা হল
সেই বাঁধের মধ্যে। লেফট্যানেন্ট
ক্যালি নির্দেশ দিল তাদেরকে
গুলি করবার। নিজেও শুরু করল গুলি।
অনেক নারীর কোলে ছিল শিশু।
তারা কাঁদতে কাঁদতে বলছিল,
‘নো ভিসি, নো ভিসি’! মানে
বলতে চাইছিল যে, তারা
ভিয়েত কং এর কেউ নয়। কিন্তু
মার্কিন সেনারা এমন ভাবে
গুলি করে যাচ্ছিল, যেন সে
মায়েরা আর তাদের কোলের
শিশুরাও ভয়ঙ্কর শত্রু। বুলেটে
ঝাঁজরা করে দিয়ে তাদের মৃত্যু
নিশ্চিত করছিল ক্যালির অনুগত
বাহিনী। পল মিডলো নামক এক
মার্কিন সেনা পরবর্তীতে
জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছিল,
সে তার ‘এম সিক্সটিন’
রাইফেলের কয়েকটা ম্যাগাজিন
শেষ করে ফেলেছিল গুলি করতে
করতে। আপনাদের অবগতির জন্য
জানাই, এম সিক্সটিন রাইফেলের
ম্যাগাজিনে সাধারণত গুলি
থাকে অন্তত ৩০ রাউন্ড। পল
মিডলো এই নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ডের
পুরো সময় জুড়েই লেফট্যানেন্ট
ক্যালির পাশে ছিল।
.
জিজ্ঞাসাবাদে ডেনিস কন্টি
নামক এক সৈন্যের কাছ থেকে
জানা যায় সেই হত্যাযজ্ঞের
মধ্যেও এক করুণতম কাহিনী। সে
জানায়, অনেক নারী তাদের
শিশুদের উপর শুয়ে পড়েছিলেন
গুলির হাত থেকে বাঁচানোর জন্য।
গুলিতে মায়েদের মৃত্যুর পর নিথর
লাশগুলোর নীচ থেকে হাঁটতে
শিখেছে এমন শিশুরা বেরিয়ে
আসছিল। তারা দাঁড়াতে না
দাঁড়াতেই ক্যালি গুলি ছুঁড়ে
হত্যা করছিল একে একে।
গ্রামবাসীর অনেক গরু-ছাগলকে
পর্যন্ত গুলি করে মেরেছিল
সৈন্যরা।
দলের সাথে এসেও কয়েকজন সৈন্য
এই নারকীয় হত্যাকাণ্ডে
সক্রিয়ভাবে জড়িত হয়নি।
মাইকেল বার্নহার্ড নামক এক
সৈন্য ছিল তেমনই একজন। সে দলের
পেছনের দিকে ছিল এবং জম-
ল্যাং গ্রামে প্রবেশ করেছিল
অনেকের পরে। বার্নহার্ডের
জবানিতে জানা যায় গণহত্যার
সেই ভয়াবহ দৃশ্যের কথা।
.
বার্নহার্ড বলে, “আমি গ্রামের পথ
ধরে এগিয়ে যেতে যেতে
সৈন্যদের নিষ্ঠুর সব কর্মকাণ্ড
দেখছিলাম। তারা মানুষের
কুঁড়েঘরগুলোতে আগুন ধরিয়ে
দিচ্ছিল। এরপর যখন ঘরের ভেতর
থেকে লোকজন বেরিয়ে আসছিল,
সাথে সাথে গুলি করে মারছিল
তাদের। ঘরের ভেতরে ঢুকেও
গুলি করছিল কেউ কেউ। কেউ
আবার কিছু গ্রামবাসীকে দল
বেঁধে দাঁড় করিয়ে তারপর গুলি
করছিল। যেদিকেই যাচ্ছিলাম, শুধু
লাশ আর লাশ। কিছু সুস্থ জীবন্ত
মানুষকে একদাথে দাঁড় করিয়ে
তাদের দিকে ছুঁড়ে মারা হচ্ছিল
গ্রেনেড। নারী আর শিশু কিছুই
বাছবিচার না করে গুলি চলছিল।
গ্রামবাসীর পক্ষ থেকে সৈন্যরা
বিন্দুমাত্র প্রতিরোধের সম্মুখীন
হয়নি।” বার্নহার্ড আরও বলে,
“আমাদের পক্ষের দিকে কোনো
ক্ষতিই হয় নি। এটা ছিল খুব
সাধারণ একটা গ্রাম। বৃদ্ধ বাবা,
সন্তান, নারী, শিশুদের নিয়েই
যেমন আর দশটা ভিয়েতনামের
গ্রাম, তেমনই। সত্যি কথা বলতে,
আমার মনেই পড়ে না, গোটা
গ্রামে সৈন্যদের বয়সী একজন পুরুষও
দেখেছি কিনা, না জীবিত না
মৃত।”
বার্নহার্ডের মত আরেক মার্কিন
সৈন্য রোনাল্ড হিবার্লিও
বলেছিল নিজের চোখে দেখা
নারকীয়তার কথা। “পনেরজনের মত
মানুষ, যাদের মধ্যে নারী আর
শিশুও ছিল, প্রায় একশ গজ দূরে
মেঠোপথ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল।
আচমকা সৈন্যরা রাইফেল তাক
করে গুলি করা শুরু করল তাদের
দিকে। শুধু গুলি নয়, গ্রেনেড
লাঞ্চার দিয়ে তারা গ্রেনেডও
ছুড়তে লাগল সেই মানুষগুলোর
দিকে। যা দেখছিলাম তাতে
নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে
পারছিলাম না।”
.
দ্বিতীয় প্লাটুনের সৈন্যরা মি-
লাই এর উত্তরাংশে অভিযান
চালিয়ে ৬০ থেকে ৭০ জনকে
হত্যা করে। মাইন আর বুবি
ট্র্যাপের মধ্যে পড়ে নিহত হয় এক
মার্কিন সেনা এবং আহত হয় সাত
জন। প্রথম ও দ্বিতীয় প্লাটুনের বর্বর
অভিযানের পর তৃতীয় প্লাটুনকে
নির্দেশ দেয়া হয় ‘বাকি’ যারা
আছে তাদের নির্মূল করার জন্য।
তখন তৃতীয় পাটুনের সদস্যরা আরও
সাত থেকে বারো জনকে খুঁজে
বের করে হত্যা করে।
ওদিকে, চার্লি কোম্পানির
সেনাদের এই হত্যাযজ্ঞ থেকে
তিন কিলোমিটার দূরে সকাল
সাড়ে আটটার দিকে পৌঁছেছিল
‘ব্র্যাভো কোম্পানি’র সৈন্যদের
একটি দল। এই দলটি আক্রমণ করে
কো-লুই পল্লীর মি-হোই নামক
জনবসতিতে। সেখানেও চলে এমন
নারকীয় হত্যাকাণ্ড। এই আক্রমণে
নিহত হয় অন্তত ৬০ থেকে ১৫৫ জন
মানুষ।
.
পরদিন পর্যন্ত দুই কোম্পানির
সৈন্যরা মিলে গ্রামের
বাড়িগুলোতে আগুন লাগায়,
তাদের জিনিসপত্র নষ্ট করে এবং
বন্দীদের উপর নির্যাতন চালায়।
জর্জিয়া সাদার্ন
বিশ্ববিদ্যালয়ের
ইতিহাস বিষয়ের অধ্যাপক
উইলিয়াম থমাস এলিসন বলেন,
সকাল শেষ হতে না হতেই চার্লি
কোম্পানির সেনারা কয়েকশ
বেসামরিক মানুষকে হত্যা
করেছিল। এর মধ্যে তারা ধর্ষণ
করে অসংখ্য নারী ও
কিশোরীকে। সৈন্যরা শত্রুপক্ষের
কোনো অস্ত্রের সম্মুখীনই হয় নি
এবং মি-লাই জনবসতিতে কোনো
অস্ত্র খুঁজেও পাওয়া যায় নি।
হিউ থম্পসন ছিলেন একজন পাইলট
যিনি হেলিকপ্টার নিয়ে
সেনাদলের সাথে এসেছিলেন
প্রয়োজনীয় সহায়তা করবার জন্য।
সনমি গ্রামের উপর দিয়ে
হেলিকপ্টার নিয়ে যাবার সময়
তিনি মৃত ও আহত মানুষদের
দেখতে পান। সেই বাঁধের পাশে
তিনি হেলিকপ্টার নিয়ে অবতরণ
করেন যেটা ছিল লাশ দিয়ে
পরিপূর্ণ। লাশের মধ্যেও কোথাও
কোথাও একটু আধটু নড়াচড়া দেখা
যাচ্ছিল। থম্পসন সেখানে চার্লি
কোম্পানির এক সার্জেন্ট
ডেভিড মিশেলের কাছে
জিজ্ঞেস করেন আহতদের
চিকিৎসা সাহায্য করবেন কিনা।
মিশেল উত্তর দেয়, তাদেরকে
কেবল মরে যেতে সাহায্য করতে
পার। এ কথা শুনে হতভম্ব হয়ে থম্পসন
এরপর লেফট্যানেন্ট ক্যালির
সাথে কথা বলতে গেলে ক্যালি
জানায়, সে শুধুই নির্দেশ পালন
করছে। এরপর হেলিকপ্টার নিয়ে
সেখান থেকে সরে যাবার সময়
থম্পসন দেখে, সার্জেন্ট মিশেল ঐ
বাঁধের মধ্যে আবার গুলি করছে।
.
থম্পসন হেলিকপ্টার থেকে
দেখেছিল, ক্যাপ্টেন মেডিনা
একজন নিরস্ত্র নারীকে লাথি
মেরে এরপর তার দিকে পয়েন্ট
ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জে গুলি করে হত্যা
করে। পরবর্তীতে মেডিনা
বলেছিল, তার নাকি মনে
হয়েছে ওই নারীর কাছে হ্যান্ড
গ্রেনেড ছিল! এরপর এক জায়গায়
থম্পসন দেখল, একটা বড় বাঙ্কার বা
গর্তের ভেতরে লুকিয়ে আছে
ভীত সন্ত্রস্ত কতগুলো মানুষ আর
একদল সৈন্য এগিয়ে যাচ্ছে
সেটার দিকে। থম্পসন সে
জায়গায় অবতরণ করে। সে তার
হেলিকপ্টারের ক্রুদের নির্দেশ
দেয়, যদি বাঙ্কার থেকে
মানুষগুলোকে বের করে আনার সময়
কোনো মার্কিন সেনা এদেরকে
গুলি করার চেষ্টা করে তাহলে
সেই সেনাদের দিকেই গুলি
চালাতে। এরপর থম্পসন
সেখানকার অধিনায়ক
লেফট্যানেন্ট স্টিফেন ব্রুকসকে
গিয়ে বলে, এই বাঙ্কারে নারী
ও শিশু আছে, তাদেরকে বের করে
আনতে হবে। তখন ব্রুকস জবাব দেয়,
তাদেরকে বের করে আনার
একটাই উপায়, সেটা হল
বাঙ্কারে গ্রেনেড নিক্ষেপ
করা। তখন থম্পসন তাকে বলে
সৈন্যদের নির্দেশ দিতে যাতে
গুলি চালানো না হয়। এরপর সে
গিয়ে বাঙ্কার থেকে
লোকগুলোকে বের করে তাদের
হেলিকপ্টারে করে নিরাপদ
জায়গায় পৌঁছে দেয়।
.
মি-লাইয়ে আবার সেই বাঁধের
কাছে ফিরে আসে থম্পসন।
বাঁধের মধ্যে তখনও কিছুর নড়াচড়া
দেখতে পেয়ে সেখানে আবার
নামে। একজন ক্রু সেই বাঁধের মধ্যে
নেমে সেখান থেকে তুলে
নিয়ে আসে একটা চার বছরের
ছোট্ট শিশুকে যে এতকিছুর
ভেতরেও অক্ষত অবস্থায় ছিল।
শিশুটিকে নিরাপদ জায়গায়
রেখে আসা হয়। মি-লাই থেকে
ফেরার পর থম্পসন তার বৈমানিক
কোম্পানির কমান্ডারের কাছে
রিপোর্ট করে সেনাদের নিষ্ঠুর
হত্যাকাণ্ডের বর্ণনা দিয়ে। তার
হেলিকপ্টারের অন্য পাইলট এবং
ক্রুরাও থম্পসনের বর্ণনার পক্ষে
সাক্ষ্য দেয়।
.
এই পুরো হত্যাকাণ্ডকে মার্কিন
বাহিনীর বিভিন্ন রিপোর্টে
‘ভিয়েত কংদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’
হিসেবে দেখানো হয়েছিল।
১২৮ জন ভিয়েত কং সৈন্য এতে
নিহত হয়েছে বলে জানানো হয়
রিপোর্টে। এমনকি ক্যাপ্টেন
মেডিনাকে সাহসীকতার জন্য
একটি প্রশংসাপত্রও দেয়া হয়!
মার্কিন বাহিনী এমন সব
হত্যাকাণ্ড নিয়মিতই চালিয়ে
যাচ্ছিল। মি-লাই গণহত্যার ছয় মাস
পর এক মার্কিন সৈন্য
সেনাপ্রধানের নিকট চিঠি
লিখেছিল এসব অন্যায় হত্যার
বর্ণনা দিয়ে। তৎকালীন মেজর ও
পরবর্তীতে মার্কিন
পররাষ্ট্রমন্ত্র
সে চিঠির ভিত্তিতে একটি
রিপোর্ট তৈরির দায়িত্ব পান
এবং মার্কিন সেনাদের এমন
কর্মকাণ্ডের কথা সম্পূর্ণ অস্বীকার
করেন সেই রিপোর্টে।
.
মি-লাইয়ে থম্পসনের ভূমিকার জন্য
তাকে ‘ডিস্টিংগুয়িশড ফ্লাইং
ক্রস’ পুরস্কার দেয়া হয়েছিল।
কিন্তু পুরস্কারের বর্ণনা হিসেবে
এক জায়গায় লেখা ছিল, সে
নাকি মি-লাইয়ে দুই পক্ষের মধ্যে
ভয়ঙ্কর যুদ্ধ চলাকালীন একটি
শিশুকে উদ্ধার করেছিল। এমন
মিথ্যা বর্ণনা দেখে পুরস্কারের
মেডেল ছুঁড়ে ফেলে দেয় থম্পসন।
১৯৯৮ সালে মার্কিন
সেনাবাহিনী আবার তাকে
পুরস্কৃত করতে চায় ‘সোলজার’স
মেডেল’ দিয়ে। এই পুরস্কারের
বর্ণনায় ছিল, ‘ভিয়েতনামের
বেসামরিক মানুষের উপর মার্কিন
বাহিনীর অন্যায় গণহত্যা
চালানোর সময় অন্তত ১০ জনের
জীবন রক্ষা করে বীরত্ব প্রদর্শনের
জন্য’ এই পুরস্কার। এই মেডেলটি
থম্পসনকে গোপনে দিয়ে কাজ
সারতে চেয়েছিল
সেনাবাহিনী। তখন সে জানায়,
সে মেডেলটি নেবে যদি এটি
জনসম্মুখে দেয়া হয় এবং যদি তার
হেলিকপ্টারের ক্রুদেরও একই
পুরস্কার দেয়া হয়।
.
মি-লাই গণহত্যার প্রায় এক বছর আট
মাস পর সিমোর হার্শ নামক এক
ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক পুরো
ঘটনা নিয়ে অনুসন্ধানী রিপোর্ট
প্রকাশ করেন এসোসিয়েটেড
প্রেসের মাধ্যমে। সে সূত্রে এ
নিয়ে রিপোর্ট করে টাইম, লাইফ,
নিউজউইক ইত্যাদি ম্যাগাজিন ও
সিবিএস টেলিভিশন। ‘প্লেইন
ডিলার’ নামের একটি পত্রিকা
প্রকাশ করে গণহত্যার কিছু ছবি।
.
এর পরপরই অভিযুক্ত সৈন্যদের
বিরুদ্ধে কোর্ট মার্শালের
উদ্যোগ নেয়া হয়। এই কোর্ট
মার্শালে মার্কিন অফিসার ও
সৈনিক মিলিয়ে মোট ২৬ জনের
বিচার শুরু হয়, এবং শেষ পর্যন্ত
কেবল লেফট্যানেন্ট ক্যালিকে
শাস্তি দেয়া হয়। লেফট্যানেন্ট
ক্যালি পরে স্বীকার করেছিল
তার জঘন্য কর্মকাণ্ডের কথা।
বাঁধের মধ্যে পরে থাকা
মানুষগুলোকে মাত্র ৫ ফুট দূরে
দাঁড়িয়ে গুলি করে মেরেছিল
সে। কিন্তু এ সবই ‘আদেশ পালন’
হিসেবে উল্লেখ করেছিল
ক্যালি। তার যাবজ্জীবন
কারাদণ্ড হলেও দুদিন পরেই
প্রেসিডেন্ট নিক্সন তাকে
কারাগার থেকে মুক্তি দিয়ে
শুধুমাত্র গৃহবন্দী রাখার নির্দেশ
দেন। সব মিলিয়ে সাড়ে তিন বছর
গৃহবন্দি ও এর মাঝখানে তিন মাস
কারাবন্দী হওয়াটাই ছিল
ক্যালির অপরাধের শাস্তি। ১৯৭৪
সালের সেপ্টেম্বরে তাকে
প্যারোলে মুক্তি দিয়ে দেয়া
হয়।
.
এই ছিল ভিয়েতনাম যুদ্ধের মি-
লাই গণহত্যার মার্কিনী বিচার।
৫০৪ জন নিরপরাধ নিরস্ত্র মানুষকে
গুলি আর বোমা দিয়ে হত্যা
করেও সে হত্যাকাণ্ডের
নির্দেশদাতা অফিসারদের
কোনো বিচার তো হয়ই নি, তার
উপর দ্বিতীয় সারির একজন
অফিসারকে সামান্য শাস্তি
দিয়েও আবার ছেড়ে দেয়া
হয়েছিল। এই হল সারা পৃথিবীতে
‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’
চালানো মার্কিন বাহিনীর
নৈতিকতার ইতিহাস।